কুরবানি শব্দের অর্থ নৈকট্য, ত্যাগ, উৎসর্গ। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ত্যাগ ও উৎসর্গ করা।
আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে ১০ জিলহজ হতে ১২ জিলহজ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গৃহপালিত হালাল পশু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করাকে কুরবানি বলে। কুরবানি করতে হয় উট, মহিষ, গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি গৃহপালিত হালান, সুস্থ ও সবল পশু দ্বারা।
নিসাব পরিমাণ মালের মাণিক সকল প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব।
কুরবানি আল্লাহর নবি হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ)-এর অতুলনীয় নিষ্ঠা ও অপূর্ব ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি বহন করে। কুরবানি দ্বারা মুসলিম মিল্লাত ঘোষণা করে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা জানমাল সবকিছু কুরবানি করতে প্রস্তুত । কুরবানির নজিরবিহীন ত্যাগের ইতিহাস স্মরণ করে মুসলমানগণ আল্লাহর দরবারে শপথ করেন যে, হে আল্লাহ! আমাদের জান-মাল, জীবন-মৃত্যু তোমারই জন্য উৎসর্গ করছি। তোমার সন্তুষ্টির জন্য আমরা যেভাবে পশু কুরবানি করছি, তেমনিভাবে আমাদের জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠিত হব না।
কুরবানি করতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে। অহংকার বা পর্বের মনোভাব নিয়ে নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আল্লাহর নিকট সেগুলোর (কুরবানির পশুর) গোশত এবং রক্ত কিছুই পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু তোমাদের তাকওয়া।' (সূরা হজ্জ, আয়াত: ৩৭)
মানুষের মধ্যে যেমন মনুষ্যত্ব আছে, তেমনি পশুত্বও আছে। কুরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরবানির মাধ্যমে পশুত্বকে হত্যা করে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা ৷
১. আমরা আগেই জেনেছি যে, নিসাব পরিমাণ মালের মালিক মুসলিম নর- -নারীর ওপর কুরবানি ওয়াজিব। তবে নাবালেগের ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়, দিলে সওয়াব হয়।
২. জিলহজ মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখ পর্যন্ত কুরবানির সময়। তবে ঈদুল আযহার সালাতের পরে কুরবানি করতে হয়।
৩. ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ, উট ইত্যাদি গৃহপালিত হালাল, সুস্থ ও সবল পশু দ্বারা কুরবানি করতে হয়। পশুটি নির্দোষ ও নিখুঁত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
৪. ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা জনপ্রতি একটি করে কুরবানি করতে হয়। গরু, মহিষ ও উট সাতজন পর্যন্ত শরিক হয়ে কুরবানি করা যায়। তবে সবার উদ্দেশ্যই আল্লাহর নৈকট্য লাভ হতে হবে।
৫. ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার বয়স কমপক্ষে এক বছর; গরু, মহিষ দুই বছর এবং উট কমপক্ষে পাঁচ বছর বয়সের হতে হবে।
৬. কুরবানির গোশত সাধারণত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিব-মিসকিন, এক ভাগ আত্মীয় স্বজন এবং এক ভাগ নিজে রাখতে হয়।
৭. কুরবানির গোশত বা চামড়া মজুরির বিনিময়ে দেওয়া যায় না। কুরবানির পশুর রক্ত ও বর্জ্য মাটিতে পুঁতে রাখতে হয়।
আল্লাহর আদেশে একদিন হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁর স্ত্রী হাজেরা এবং তাঁদের বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ)-কে মক্কায় তখনকার দিনে লুপ্ত কাবার নিকটবর্তী জনমানব শূন্য মরুভূমিতে রেখে চলে যান। আল্লাহ তায়ালার অপার করুণায় তাঁরা নিরাপদে থাকেন।
ইসমাঈল (আ) যখন কিশোর বয়সে উপনীত, তখন ইবরাহীম (আ) তাঁদের দেখতে এলেন। এবার তিনি এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহ তাঁকে আদেশ করছেন প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ)-কে কুরবানি করতে। একই স্বপ্ন দেখলেন বারবার। তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পুত্রকে কুরবানি করতে মনস্থির করলেন। তিনি তাঁর স্বপ্নের কথা ইসমাঈল (আ)-কে জানিয়ে বললেন, “হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কী বলো।' উত্তরে ইসমাঈল (আ) বললেন, “হে আমার আব্বা, আপনি তাই করুন যা আপনাকে আদেশ করা হয়েছে। ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।' (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ১০২)
পথে পিতা-পুত্রকে শয়তান ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাঁরা শয়তানকে পাথর মেরে তাড়িয়ে দিলেন ।
ইবরাহীম (আ) আল্লাহর প্রতি তাঁর পুত্রের এমন আনুগত্য, নিষ্ঠা ও সাহসিকতাপূর্ণ উত্তরে খুশি হলেন। তিনি প্রাণপ্রিয় পুত্রকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করতে তাঁর গলায় ছুরি চালালেন। পুত্র ইসমাঈলও আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ধারাল ছুরির নিচে মাথা পেতে দিলেন। এবারের কঠিন পরীক্ষায়ও পিতা-পুত্র উত্তীর্ণ হলেন। আল্লাহ তায়ালা কুরবানি কবুল করলেন এবং ইসমাঈলকে রক্ষা করলেন। তাঁর পরিবর্তে একটি দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল।
আল্লাহ তায়ালার প্রতি হযরত ইবরাহীম (আ) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ)-এর অপরিসীম আনুগত্য ও অপূর্ব ত্যাগের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য এবং মুসলিমদের ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করার জন্য তখন থেকে কুরবানির প্রচলন রয়েছে। এটি চিরকালের জন্য মানবসমাজে একটি পবিত্র ধর্মানুষ্ঠানরূপে প্রতিষ্ঠিত।
১. মুসলিমদের ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করাই কুরবানির উদ্দেশ্য।
২. আমাদের জান-মাল, জীবন-ম -মৃত্যু আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করা।
৩. কুরবানি দ্বারা আল্লাহ তায়ালা মানুষের তাকওয়া যাচাই করেন। আল্লাহর কাছে কুরবানির পশুর রক্ত, মাংস কিছুই পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু অন্তরের তাকওয়া ও নিষ্ঠা ।
৪. মানুষের মধ্যে যেমন মনুষ্যত্ব আছে, তেমনি পশুত্বও আছে। কুরবানির মাধ্যমে পশুত্বকে হত্যা করে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা হয়। মানুষের লোভ-লালসা, হিংসা- বিদ্বেষ, অহংকার ইত্যাদি পাশবিক চরিত্র বিসর্জন দিয়ে মানবীয় গুণাবলি উজ্জীবিত করতে পারলেই কুরবানি স্বার্থক হয়।
৫. কুরবানির একটি অংশ পরিব-মিসকিনকে দিতে হয়, এতে তাদের একটু ভালো খাওয়ার সুযোগ হয়। আত্মীয়াজনকে দিতে হয়, এতে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হয়। সকলের মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়।
Read more